ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে নারীর সম্পদ ও অধিকারের বিষয়টি ধর্মীয় গ্রন্থে সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, যা আধুনিক সমাজে আইনি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। ধর্মীয় শাস্ত্রের রেফারেন্স এবং আধুনিক বাস্তবতার সমন্বয়ে এই বিষয়টি এখানে তুলে ধরা হলো।
ইসলামে নারীর সম্পত্তির অধিকার কুরআন ও হাদিসে স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত। কুরআনের সূরা আন-নিসা (৪:৭) বলে, “পুরুষদের জন্য তাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে অংশ আছে, এবং নারীদের জন্যও তাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে অংশ আছে, তা অল্প হোক বা বেশি, নির্ধারিত অংশ হিসেবে।” এটি নারীর উত্তরাধিকারের অধিকার নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন কন্যা পিতার সম্পত্তির অর্ধেক পায়, যেখানে পুত্র দ্বিগুণ পায়, তবে এটি পুরুষের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত।
বিয়ের সময় মোহরানা নারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত। সূরা আন-নিসা (৪:৪) বলে, “তোমরা নারীদের তাদের মোহরানা স্বেচ্ছায় দিয়ে দাও।” এই সম্পত্তির উপর স্বামীর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এছাড়া, শিক্ষার অধিকারও ইসলামে জোরালোভাবে উল্লেখিত। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “শিক্ষা অর্জন প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য ফরজ” (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২২৪)।
বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১, নারীর সম্পত্তির অধিকারকে আইনি কাঠামো দিয়েছে। তবে, গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক প্রথা, অশিক্ষা ও ভুল ধর্মীয় ব্যাখ্যা নারীদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, পারিবারিক চাপে অনেক নারী তাদের উত্তরাধিকার ত্যাগ করতে বাধ্য হন। আধুনিক মুসলিম নারীরা শিক্ষা ও চাকরিতে অগ্রগতি দেখালেও, সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় আরও পদক্ষেপ প্রয়োজন।
হিন্দু ধর্মে ঐতিহ্যগতভাবে নারীর সম্পত্তির অধিকার সীমিত ছিল। মনুস্মৃতি (৮:৪১৬) বলে, “নারীকে স্বাধীনভাবে সম্পত্তি পরিচালনার অধিকার দেওয়া উচিত নয়, তবে তার স্ত্রীধন তার নিজস্ব।” স্ত্রীধন, অর্থাৎ বিবাহের সময় প্রাপ্ত সম্পত্তি বা উপহার, নারীর ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। ঋগ্বেদ (১০:৮৫:৪২) বিয়ের সময় নারীর সম্মান ও গৃহে তার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে, যেখানে বধূকে “গৃহের লক্ষ্মী” হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
প্রাচীনকালে গার্গী বা মৈত্রেয়ীর মতো নারী দার্শনিকদের উদাহরণ থাকলেও, সাধারণ নারীর শিক্ষা ও স্বাধীনতা সীমিত ছিল। মনুস্মৃতি (৫:১৪৭) বলে, “নারীকে সবসময় পিতা, স্বামী বা পুত্রের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে,” যা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে প্রতিফলিত করে।
ভারতের হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, ১৯৫৬ (২০০৫ সালে সংশোধিত) এবং বাংলাদেশে এর প্রয়োগ নারীদের পৈতৃক সম্পত্তিতে সমান অধিকার প্রদান করেছে। এটি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বড় পদক্ষেপ। তবে, গ্রামীণ হিন্দু সম্প্রদায়ে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা, দেনমোহর, এবং সামাজিক চাপ নারীদের অধিকার প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক নারী সামাজিক চাপে সম্পত্তির অধিকার ত্যাগ করেন।
নারীর সম্পদ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় শিক্ষার সঠিক ব্যাখ্যা, আইনি সচেতনতা, এবং শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে আধুনিক সমতার সমন্বয় নারীর ক্ষমতায়নের পথকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
কুরআন ও হাদিসে নারীর সম্পত্তি ও শিক্ষার অধিকার সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত, যেখানে হিন্দু শাস্ত্রে স্ত্রীধন ও নারীর সম্মানের কথা বলা হয়েছে। আধুনিক আইনি সংস্কার এই অধিকারগুলোকে শক্তিশালী করলেও, সামাজিক সচেতনতা ও শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে এই অধিকারগুলো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।