শেরপুর, বগুড়া,: বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় বেওয়ারিশ কুকুরের উপদ্রব এখন স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের জন্য মারাত্মক আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৌর শহরের হাসপাতাল রোড, খন্দকারপাড়া, ধুনট মোড়, খেজুরতলা, কলেজ রোড, পুন্নাতলা, ডিজে হাইস্কুল মাঠ, খন্দকারটোলা ও শেরুয়া এলাকায় প্রতিদিন ১০–১৫টি কুকুরের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব এলাকায় স্কুলে যাওয়ার পথে শিক্ষার্থীরা প্রায়ই কুকুরের হামলার শিকার হচ্ছে, যা তাদের মনে গভীর ভয়ের সঞ্চার করছে।
স্কুলে যাওয়ার পথে বেওয়ারিশ কুকুরের হঠাৎ ঘিরে ধরা এবং ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করা এখন শেরপুরের শিক্ষার্থীদের জন্য নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে সকালে এবং বিকেলে স্কুলে যাওয়া-আসার সময় শিশুরা কুকুরের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী ভয়ে একা চলাচল করতে পারছে না, এবং অভিভাবকদের সঙ্গে স্কুলে যেতে হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে কুকুরের কামড়ে আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে, যা জলাতঙ্কের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

শেরপুর উপজেলা হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১০–১৫ জন কুকুরের কামড় নিয়ে হাসপাতালে আসছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী। গত ১০ মাসে কয়েকশ মানুষ জলাতঙ্ক প্রতিরোধক টিকা নিয়েছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলেছে, কুকুর কামড়ালে প্রথমে ক্ষতস্থান চেপে ধরতে হবে, যাতে তাড়াতাড়ি রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়। এরপর হাল্কা গরম পানি দিয়ে এবং খার-জাতীয় বা সাবান দিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধরে ক্ষত পরিষ্কার করতে হবে। যতটা সম্ভব আক্রান্ত স্থানকে উঁচু করে রাখার চেষ্টা করতে হবে। পরবর্তীতে সরকারিভাবে হলে ৪টি আর বেসরকারিভাবে হলে ৫টি ভ্যাকসিন শূন্য, তৃতীয়, সপ্তম, ১৪ ও ২৮তম দিনে দিতে হবে।
স্থানীয় অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গৃহিণী রোকেয়া খাতুন বলেন, “আমার মেয়ে স্কুলে যেতে ভয় পায়। কুকুরগুলো হঠাৎ ঘিরে ধরে, কখনো তাড়া করে। আমি নিজে সঙ্গে যাই, তবুও ভয় লাগে। পৌরসভার উচিত এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া।”
অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মাসুদ রানা বলেন,
“স্কুলে যেতে সকালে বের হলেই কুকুরের দল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা হাঁটতে পারি না, দৌড়ালে ধাওয়া করে। তাই প্রতিদিন ভয়ে স্কুলে আসি।”
ছাত্রী রিমা খাতুন বলেন,
“আমরা মেয়েরা একা চলতে পারি না। অনেক সময় কুকুর সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন মনে হয় স্কুলেই না যাই। বাবা-মা প্রতিদিন চিন্তায় থাকেন।”
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আব্দুল হাকিম বলেন, “শিশুদের স্কুলে যাওয়ার পথে এভাবে ভয়ে থাকা উচিত নয়। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় কুকুরই এখন রাস্তার মালিক।”
কুকুরের উপদ্রব শুধু শিক্ষার্থীদের আক্রমণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কসহ বিভিন্ন সড়কে কুকুর রাস্তা পার হওয়ার সময় যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য এই রাস্তাগুলো আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কারণ তারা প্রায়ই সাইকেল বা হেঁটে স্কুলে যায়।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. নিয়াজ কাজমির রহমান জানান, “২০২৫ সালে জলাতঙ্ক দিবসে আমরা ১০টি কুকুর ও বিড়ালকে ভ্যাকসিন দিয়েছি। এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।” তবে তিনি স্বীকার করেন, বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আরও বড় পরিসরে কাজ দরকার।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সাজিদ হাসান সিদ্দিক বলেন, “আমাদের চাহিদা ১৫০০ ভ্যাকসিনের, কিন্তু পেয়েছি মাত্র ২০০। পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন থাকলে আরও বেশি শিশু ও রোগীকে সেবা দেওয়া যেত।”
শেরপুর পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের আলাদা ভ্যাকসিন কার্যক্রম নেই। তবে নাগরিকদের অনুরোধে প্রাণিসম্পদ অফিসের সহায়তায় কুকুর ধরে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।”
২০১৪ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে কুকুর নিধনে নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এটি শেরপুরে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। জলাতঙ্কের ঝুঁকি এবং ভ্যাকসিন সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে।