বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় পুকুরের সংখ্যা বাড়লেও বাণিজ্যিক মাছ চাষের আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে পুকুরকেন্দ্রিক ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ জীবনযাত্রা। একসময় যেখানে শিশুরা সাঁতার শিখত, দলবেঁধে গোসল করত, আর দিনমজুররা প্রশান্তি খুঁজত, এখন সেসব পুকুর জালে ঢাকা পড়ে শিশুদের জন্য নিষিদ্ধ হচ্ছে। এর ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদ, চিকিৎসক ও অভিভাবকরা।
শেরপুর উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, বর্তমানে উপজেলায় ছোট-বড় মিলে ৩,৩৬৩টি পুকুর রয়েছে, যা থেকে বছরে ১০,৯৬৭ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। এটি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২,৭৫৪ মেট্রিক টন বেশি। বগুড়া জেলায় প্রায় ৬০,০০০ পুকুর রয়েছে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থানে থাকলেও, এই বাণিজ্যিকীকরণ শিশুদের জন্য পুকুরের প্রাকৃতিক ব্যবহারকে সীমিত করে দিয়েছে।
পরিবেশবাদীদের মতে, পুকুর শুধু জলাধার নয়, এটি শহরের জন্য ‘শ্বাস-প্রশ্বাসের’ মতো। পুকুর ভরাট হওয়ার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে এবং বর্ষায় জলাবদ্ধতা বাড়ছে। বাণিজ্যিক মাছ চাষে ব্যবহৃত জাল পাখির খাদ্যাভ্যাস ব্যাহত করছে এবং বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করছে। গত দুই দশকে শেরপুর ও বগুড়া শহরে বহু পুকুর দখল, ভরাট ও ভবন নির্মাণের শিকার হয়েছে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানান, মাছ চাষে সম্পূরক খাদ্য ব্যবহার ক্ষতিকারক না হলেও, কিছু অসাধু চাষি নিম্নমানের খাদ্য, মুরগির বিষ্ঠা বা ক্ষতিকারক রাসায়নিক ব্যবহার করলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ে। এই ধরনের উপাদান মাছের গুণমান কমায় এবং মানুষের ত্বকের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।
ডা. ন.ম গোলাম হামিম বলেন, “সাঁতার শিশু ও কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অত্যন্ত কার্যকর। এটি শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সক্রিয় রাখে, স্ট্যামিনা ও ফুসফুসের সক্ষমতা বাড়ায় এবং মানসিক প্রশান্তি দেয়। কিন্তু শহরের শিশুরা এই প্রাকৃতিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাদের মধ্যে স্থূলতা, হাঁপানি, একাগ্রতার অভাব, মানসিক চাপ ও অবসাদের মতো সমস্যা বাড়ছে।” শিশুদের জন্য সুইমিংপুল একটি বিকল্প হলেও তা ব্যয়বহুল এবং সবার জন্য সহজলভ্য নয়।
পুকুরের ঐতিহ্য ধরে রাখা এবং শিশুদের সুস্থ শৈশব নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সাশ্রয়ী সাঁতারের সুবিধা এবং পুকুর সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করেন পরিবেশবিদ ও স্থানীয় বাসিন্দারা। পুকুরগুলো শুধু মাছ চাষের ক্ষেত্র না হয়ে, যেন জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেও টিকে থাকে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।