এনাম হক: লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) বন্ধ বা বিলম্বিত হলেই দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলা ও কৃষিপণ্যের দামের অস্থিরতা এখন নিয়মিত চিত্র। বগুড়ার স্থানীয় পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলো পুরোপুরি বিদেশ-নির্ভর হওয়ায়, ডলার সংকট এবং এলসি জটিলতার সরাসরি প্রভাব পড়ছে সাধারণ ভোক্তার ওপর। সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মসলা আমদানিতে সামান্য বাধা এলেই কয়েকদিনের মধ্যে দাম বেড়ে যাচ্ছে আকাশছোঁয়া।
বগুড়া শহরের পাইকারি বাজার, সাজাহানপুরের নয়মাইল হাট এবং শেরপুর উপজেলার বাজারগুলো ভারত, চীন, মিয়ানমার, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও ভিয়েতনাম থেকে আমদানিকৃত মসলার ওপরই নির্ভরশীল।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, ভুটান থেকে আসা কালো এলাচ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২,৪০০ টাকায়। পাকিস্তানের গুজরাট ও ভারত থেকে আসা সাদা এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৪,২০০ থেকে ৪,৩০০ টাকায়। মিয়ানমার থেকে আসা তেঁতুল কেজিপ্রতি ৩৭০ টাকা এবং হলুদ ২৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে, চীন থেকে আমদানিকৃত রসুনের পাইকারি দাম ১২৫ টাকা এবং গাজর ১৩৫ টাকা (খুচরা ১৬০ টাকা) দরে বিক্রি হচ্ছে। ভারত থেকে আসা দারুচিনি ৪৩০-৪৪০ টাকা, জিরা ৫৩০-৫৪০ টাকা এবং লবঙ্গ ১,৩০০ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে।

বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশি মসলার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতাই এই অস্থিরতার মূল কারণ। এলসি বন্ধ থাকলেই এক-দুই দিনের মধ্যেই বাজারে দামের প্রভাব পড়ে।
শেরপুরের ফুলবাড়ি বাজারের ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, “বাজারের বেশিরভাগ মসলা বিদেশ থেকে আসে। তাই পণ্যগুলোর এলসি বন্ধ হলেই এক-দুই দিনের মধ্যেই দাম বেড়ে যায়। বিশেষ করে এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, জিরা এবং কাঁচামরিচের মতো মসলায় প্রভাব বেশি পড়ে।”
শেরপুর বাজারের আরেক ব্যবসায়ী আব্দুল ওহাবের তথ্যমতে, এলসি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে দামে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত পার্থক্য সৃষ্টি হয়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “কিছুদিন আগে এলসি বন্ধ থাকার কারণে সাদা এলাচের দাম ৩,১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৪,৬০০ টাকায় পৌঁছেছিল—প্রায় দেড়গুণ পার্থক্য।”
সবজি ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন জানান, “এবার পূজার সময় এলসি বন্ধ থাকায় কাঁচা মরিচের দাম এক লাফে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে গিয়েছিল।”
ব্যবসায়ী আব্দুল ওহাব দামের অস্থিরতা কমাতে আমদানি শুল্ক হ্রাস এবং নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি দেশীয়ভাবে মসলার উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিতে বলেছেন।
শেরপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জুলফিকার হায়দার। তিনি বলেন, “এ বছর শেরপুরে শীতকালীন পেঁয়াজ ৬৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে, ফলন ৭৮০ মেট্রিক টন। মরিচ ৮০ হেক্টরে চাষ করে ১,২০০ মেট্রিক টন ফলন হয়েছে এবং রসুন ৫০ হেক্টরে চাষ করে ৩৫০ মেট্রিক টন পাওয়া গেছে। কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, তবে এখানে কালো এলাচ, সাদা এলাচ, দারুচিনি, জিরার মতো মশলা চাষ হয় না।”
বগুড়া মশলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম জানান, “বিদেশি মশলার ফসলগুলো আমাদের আবহাওয়ায় পুরোপুরি উপযোগী নয়। তবে কালো এলাচ পাহাড়ি এলাকায় চাষ সম্ভব। দারুচিনি ও গোল মরিচ বগুড়ায় সীমিত আকারে চাষ হচ্ছে। লবঙ্গ ও সাদা এলাচ বান্দরবানে পরীক্ষামূলক চাষ করা যেতে পারে। দারুচিনি চাষে মানুষ আগ্রহ দেখাচ্ছে, আমরা চারা বিতরণ করছি। গবেষণার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে চাষযোগ্য জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে, যাতে ভবিষ্যতে বিদেশি নির্ভরতা কমে।”
কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জুলফিকার হায়দার প্রধান যোগ করেন, “আমাদের দেশে জিরা ও দারুচিনির নিজস্ব জাত আছে। গবেষণায় এগুলোর ফলন ও গুণগত মান উন্নয়নের কাজ চলছে। এগুলো সম্প্রসারণ করতে পারলে দেশীয় উৎপাদন বাড়বে এবং আমদানিনির্ভরতা কমবে।”